ফিরে
যাই একাত্তরে
মিফরা
বিকেলে রিফা এসে বাসার সামনে নতুন কেনা
মারুতি গাড়িটা দেখে না জানি কত খুশি হবে। রিফা যথারীতি বাসায় ফিরে আসলো। লাল
মারুতিটা পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো। কৌতুহল নিয়ে একবার ভাল করে তাকালোনা পর্যন্ত। মনে
হল লাল মারুতি নয় ও বুঝি একটা ভাঙ্গা চেয়ারকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমি ওর কৌতুহল
আর উচ্ছ্বাস দেখবো বলে বেশ আগে থেকেই দোতলার বারান্দায় তাড়িয়ে ছিলাম। ও ঘরে ঢুকতেই
আমি আমার উচ্ছ্বাস দমিয়ে রাখতে পারলাম না। ওকে বললাম জানিস রিফা নিয়ে যে নতুন লাল
মারুতি গাড়িটা দেখলি ওটা কাদের গাড়ি? ও বলল কাদের গাড়ি? আমি বললাম ওটা বাবা আজই
আমাদের জন্য কিনে এনেছে। হায়! কাকে কি বলছি! ক্লাস ফোরে পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে নতুন
গাড়ির কথা শুনে আনন্দে ফেটে পড়বে তা না! সে কোন কথাই বললো না কেবল বললো ও! আমি
বললাম ও কি? গাড়িটা তোমার পছন্দ হয়নি? রিফা এবারও কোন উত্তর দিলনা। আমার বেশ রাগ
হচ্ছিল। কিন্ত রিফাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি । আমি ওর কাছে গিয়ে কাধে হাত রেখে
বললাম রিফা তোমার কি মন খারাপ? নাতো বেশ ভালইতো! বেশ ভালইতো বলতে রিফা কি গাড়িটার
কথা বললো নাকি নিজে ভাল আছে সেটা বললো তা বুঝলাম না। আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাত
পেরোলেই সকাল। সেই সকালে বাবার সাথে নতুন গাড়িতে স্কুলে যাব এর চেয়ে আনন্দ আর
হয়না।রাতে বোধহয় ঘুমের মাঝেও আমি গাড়ির স্বপ্নে বিভোর থাকলাম। রিফাকে তাড়া দিলাম
রেডি হওয়ার জন্য কিন্ত ও ওর মত রেডি হতে থাকলো। নতুন গাড়িতে স্কুলে যাব বন্ধুরা
সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে সেই সব মনের মধ্যে ভাসতে থাকলো। রিফাকে বলতেই ও
বললো গাড়িতে করে সে স্কুলে যাবেনা। আমার আবারও মন খারাপ হয়ে গেল। রিফাকে আমি খুব
ভালবাসি। ও যদি গাড়িতে স্কুলে না যায় তাহলে আমি ওকে রেখে কি করে নতুন গাড়িতে
স্কুলে যাই? কিন্ত বাবা এসে রিফাকে হাত ধরে পিছনের সিটে নিয়ে বসালে আমিও ওর পাশে
বসলাম। আশ্চর্য আমি বললাম সে রাজি হলনা কিন্ত বাবা বলতেই কোন না করলোনা।
রিফা খুব ভাল মেয়ে। বাবাকে কষ্ট দিতে
চায়না। আমার মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদেরকে নতুন গাড়ির কথা বলতেই
ওরা সবাই রুপকথার গল্প শোনার মত আমার কথা শুনতে লাগলো। আমার আর কোন বন্ধুদের এতো
দামি গাড়ি নেই। দু একজনের সিএনজি চালিত অটো রিক্সা আছে নয়তো ট্যাক্সিক্যাব আছে।
সুতরাং আমার দামটা একটু বেড়েই গেল। আমি আমার বন্ধুদেরকে নতুন গাড়ির কথা বলতে বলতে
যেমন দিন কাটিয়েছি রিফার ক্ষেত্রে হয়েছে তার উল্টো। রিফার বন্ধুরা সারাদিন ওকে
গাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করেছে কিন্ত ও তাদের কিছুই বলেনি। স্কুল ছুটির কিছুক্ষণ আগেই
আমাদের নিতে নতুন গাড়িটা চলে আসলো। আমার বন্ধুরা গাড়িটা ঘিরে ধরলো। বাবা আসেনি
ব্যস্ততার কারণে। আহাদ ভাই এসেছেন আমাদেরকে নিতে। আহাদ ভাই খুব ভাল। আমাদেরকে খুব
আদর করেন। আমি দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলাম কিন্ত রিফা উঠলোনা। ও জানালো ও গাড়িতে
করে স্কুলে যাওয়া আসা করবেনা। ও যা বলে তাই সই। আমি গাড়ি থেকে নেমে ওকে বুঝালাম ও
শুনলোনা। শেষে আহাদ ভাই বাবাকে ফোন করলো। বাবা রিফার সাথে কি কথা বললো জানিনা শেষে
আহাদ ভাই গাড়ি নিয়ে ফিরে গেলেন। রিফা গাড়িতে না চড়লে আমি কি করে চড়ি। আজকের আগে
আমি কখনো রিফার সাথে একসাথে স্কুলে আসা যাওয়া করিনি। ও ওরমত স্কুলে যায়। আমি স্কুল
শেষ করে কোচিং শেষে পরে ফিরি। তার আগেই ও বাসায় ফেরে। সামনে পরীক্ষা বলে কিছুদিনের
জন্য ও আমাদের কোচিং এ পড়বে। তাই এখন থেকে একসাথেই আসা যাওয়া করতে হবে। যেহেতু
গাড়ি আছে তাই আনন্দের সাথে যাওয়া আসা হবে ভেবেছিলাম। রিফার কি জানি কি হলো মনটা
খারাপ হয়ে গেল। আমি রিফাকে বললোম চলো এখন রিক্সায় বাসায় ফিরি। বসুনিয়া পট্টিতে
আমাদের বাসা। ডাক্তার ছমির উদ্দিনের বাসায় যাব বললে শহরের সব রিক্সা ওয়ালাই আমাদের
বাসা চেনে। আমার দাদাকে সবাই এক নামে চেনে।
আমার বেশ ভাল লাগে। দাদা নেই অথচ দাদার
নামটা রয়ে গেছে। একটা রিক্সা আসতেই বললাম বসুনিয়া পট্টি যাবেন? রিক্সাওয়ালা রাজি
হলেন। আমি রিক্সায় উঠে বসলেও রিফা উঠলোনা। বললো আমি এ রিক্সায় যাবনা। একটু পরে
যাব। আমার এতো আদরের বোনটার যে কী হল তা বুঝতে পারলামনা। ওকে বুঝতে হলে আমার অনেক
ধৈর্য ধরতে হবে। এভাবে বেশ কয়জন
রিক্সাওয়ালা বিদায় হবার পর একটা রিক্সায় উঠলাম। রিক্সায় রিফাই আগে উঠলো। ওর চোখে
মূখে কিছুক্ষণ আগের সেই মনখারাপের চিহ্ন নেই। রিফার খুশিই আমার খুশি। রিকআওয়ালা
রিক্সা চালাচ্ছে না টেনে নিচ্ছে বুঝলাম না। রিক্সা যেন চলছেইনা। আমার খুব বিরক্ত
লাগছিল। এরকম বুড়ো একজনের রিক্সায় রিফা কেন উঠলো। আমি গলা ফাটিয়ে বললাম রিক্সা
জোরে চালাতে পারেনাতো রিক্সা চালান কেন? রিক্সা ওয়ালা মূখটা হাসি হাসি রেখেই বললেন
বুড়া হইছিতো শরীল কুলায় না।রিফার দিকে তাকিয়ে দেখি কেন যেন ওর মনটা আবার খারাপ হয়ে
গেছে। কি হয়েছে জানতে চাইলেও ও কোন উত্তর দিলনা। রিক্সা এতই আস্তে চলছিল যে বিরক্ত
হয়ে বললাম একাত্তুরে পাকিস্তানিরা কত মানুষ মারলো আপনাকে যে কেন মারলোনা বুঝলামনা।
আপনি মরলো আর এরকম আস্তে আস্তে চালানো রিক্সায় উঠতে হতনা। আমি রিক্সা থেকে সে
অবস্থায়ই নেমে পড়লাম। রিফাকেও নামতে বললাম কিন্ত ও নামলোনা। আমি রিফার সব কিছুতেই
আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।কি আর করা আদরের বোনটা যা করবে তাতো মেনে নিতেই হবে। অগত্যা
সেই থুত্থুড়ে বুড়োর রিক্সাতেই সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরলাম। আমি দশটাকার একটা নোট
দিতে গেলেও রিফা দিতে দিলনা। বইয়ের ভাজ থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে বুড়ো
রিক্সাওয়ালাকে দিল।
রিক্সাওয়ালা হাসি মূখে সেটা নিয়ে চলে
গেল। রিফা আর আমি ঘরে ঢুকলাম। রিফার চোখ ভর্তি জল। রাতে আমার সাথে কথা বললোনা।
বাবাকে খাবার টেবিলে সে বললো সে নতুন কেনা মারুতি গাড়িতে করে স্কুলে যাবেনা। কেন
যাবেনা তার কারণ তার বন্ধুদের কারো গাড়ি নেই। এমনকি এমন অনেক বন্ধু আছে যারা
রিক্সা ভাড়াও দিতে পারেনা। ও গাড়িতে গেলে বন্ধুদের মন খারাপ হবে। তারা ভাববে ইস
রিফারা কত বড়লোক। কী দামি গাড়িতে আসছে। আমরা যদি বড়লোক হতাম। রিফার এক কথা সবাই
একরকম হতে হবে। বন্ধুরা কষ্ট পাক তা সে করতে পারবেন। বাবা কিছু বললেন না। শুধু
বললেন ঠিক আছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ও গাড়িতে না চড়লে আমি কি করে চড়ি।
পরদিন আবার স্কুল শেষে সেই বুড়োটার রিক্সায় উঠলাম। এভাবে তিন চারদিন যাওয়ার পর
বিরক্তি চরমে উঠলো। আমি আবার সেই একই কথা বললাম। পাকিস্তানিরা কেন যে আপনাকে
মারলোনা বুঝলামনা।
আমাদের কষ্ট দেয়ার জন্যই বোধহয় আপনি বেচে
আছেন।কাল থেকে আপনি আর আমাদের স্কুলের সামনে আসবেন না। আমার ভাষা আরও রুড় হল।
ততক্ষণে বাসার সামনে চলে এসেছি। রিক্সা থামতেই রিফা নেমে ব্যাগটা কাধে নিয়ে দৌড়ে
বাসায় ঢুকে গেল। রোজ ও রিক্সাওয়ালা বুড়োকে ভাড়া দেয় আজ ভাড়া না দিয়ে চলে
গেল।ভাবলাম হয়তো ওর কাছে আজ কোন টাকা ছিলনা। আমি ব্যাগের পকেট থেকে দশটাকার সেই
নোটটা বের করে রিক্সাওয়ালা বুড়োর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। রিক্সাওয়ালার চোখ দুটো ভেজা
ভেজা। আমার কথায় বোধ হয় কষ্ট পেয়েছে। তারতো কষ্ট পাওয়ার কথা নয়। যা সত্যি তাই
বলেছি। আমার হাতের দশটাকা হাতেই থাকলো। তিনি টাকা না নিয়ে চলে গেলেন। রাগ করে টাকা
নেয়নি তাতে আমার কি! ভেবে বাসায় ঢুকলাম। মাত্র দশ মিনিটও হয়নি বাসায় ঢুকে দেখি আম্মু
রিফার মাথায় পানি ঢালছে।আহাদ ভাইয়া টেলিফোনে ডাক্তার চাচ্চুর সাথে কথা বলছে। রিফার
হঠাৎ ভীষণ জ্বর এসেছে। শরীর কেপে কেপে উঠছে।
রিক্সায় পাশাপাশি আসার সময়ও জ্বর ছিল বলে
মনে হয়নি। আমার একটা হাততো সব সময় রিফার কাধের ওপরই ছিল। রিক্সা ভাড়া দিতে যেটুকু
সময় লাগে সেই সময়ের মধ্যেই ওর জ্বর আসলো কি করে জানিনা। তখন মনে হল কেন সে রিক্সা
ভাড়া না দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকেছে। রিফার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি ওর
কপালে হাত রাখলাম। ও হাতটা সরিয়ে দিল। ওর বোধ হয় খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি রাতে ওর
বিছানার পাশে অনেকক্ষণ ছিলাম কিন্ত ও কথা বললোনা। ওর জ্বর কমেনি। আমার শাকিল
চাচ্চু মস্ত বড় ডাক্তার। চাচ্চু ওকে খুব ভাল করে দেখেছেন,ওষুধ দিয়েছেন কিন্ত ওর
জ্বর কমছেনা। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার এতো আদরের বোনটা জ্বরে পড়ে কত কষ্টইনা
পাচ্ছে। পর পর বেশ কিছুদিন রিফা অসুস্থ বলে স্কুলে যেতে পারেনি। আমি একাই স্কুলে
গেছি। এতো করে বলার পরও সেই বুড়ো রিক্সা ওয়ালা ঠিকই ওখানে এসেছে। আমার বিরক্ত ধরে
গেছে। লোকটার কোন লজ্জা নেই। যাচ্ছেতাই বলার পরও ঠিকই এসেছে। কিন্ত একদিনও আমি তার
রিক্সায় চড়িনি। অন্য রিক্সায় খুব দ্রুত বাসায় ফিরেছি। ফেরার পথে দেখেছি
রিক্সাওয়ালা স্কুলের সামনেই দাড়িয়ে আছে। থাক সে যতক্ষণ ইচ্ছে দাড়িয়ে তাক তাতে আমার
কি? বুড়ো থুত্থুড়ে রিক্সা চালাতেই পারেনা! তার রিক্সায় রিফার মত বোকা ছোট্ট মেয়ে
ছাড়া আর কে চড়বে! পাঁচদিন হল রিফা জ্বরে ভুগছে।
শাকিল চাচ্চু এতো চিকিৎসা দেবার পরও ওর
জ্বর কমছেনা। সিদ্ধান্ত হল ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। এ কয়দিন একটি বারের জন্যও রিফা
কোন কথা বলেনি। ওর শরীরটা খুব দুর্বল। উঠে বসতেও পারেনা। যেদিন ওকে ঢাকায় নিয়ে
যাওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হল ঠিক তার আগের দিন সকালে ব্রাশ করতে করতে দোতলার
বারান্দায় এসেছি। নিচে তাকাতেই দেখি সেই বুড়ো রিক্সাওয়ালা। সাতসকালে ওনাকে দেখে
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। দোতলা থেকে নেমে বাইরে আসলাম। কি ব্যাপার আপনি এখানে
এসেছেন কেন? উনি বললেন রিফা মনিকে কয়দিন হল স্কুলে যাইতে দেহিনা। আমার মেজাজটা আরও
চড়ে গেল। যা মূখে আসলো তাই বললাম। বললাম রিফা যায়না বলে আপনার প্রতিদিন দশটাকা কম
আয় হচ্ছে তাইনা? দাড়ান বলে রুমে ফিরে বাবার দেয়া সেই একশোটাকার নোটটা নিয়ে বুড়ো
রিক্সা ওয়ালার কাছে ফিরে আসলাম। টাকাটা দিয়ে বললাম এখন যান এই টাকা নিয়ে খুশি
থাকেন। আর আমাদের ধারে কাছে আসবেন না। বুড়ো রিক্সাওয়ালা টাকা নিলনা। দাড়িয়ে থাকলো।
আমার চিৎকার শুনে বাবা গেটের বাইরে আসলেন। রিফা অসুস্থ বলে বাবারও মন খারাপ।
চিৎকার করছি কেন জানতে চাইলে বাবাকে যা
বলার বললাম। বাবা সংক্ষেপে বুড়ো রিক্সাওয়ালাকে বললেন রিফা খুব অসুস্থ তাই স্কুলে
যায়না। সুস্থ হলে ও আবার স্কুলে যাবে আপনি এখন যান। রিক্সা ওয়ালা বললেন আমিকি
বাচ্চাডারে একবার দেখতি পারি। আমি মূখ ফসকে বলেই ফেলাম না আপনার দেখতে হবেনা। আপনি
যান। বাবা আমাকে থামিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। এ কয়দিনে রিফার
অবস্থা কংকালসার। কারো সাথে একটি বারের জন্যও সে কথা বলেনি। বুড়ো রিক্সাওয়ালা
রিফার বিছানার পাশে বসলেন। রিফার চোখ বন্ধ ছিল। ও হয়তো ঘুমোচ্ছে। বুড়ো রিফার কপালে
হাত রাখলেন। আমি বললাম কি করছেন? আপনার কি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নেই। বাইরে থেকে
এসেছেন হাতে কত জীবাণু। ও হাত দিয়ে রিফাকে ছুবেননা। বাবা আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে
দিলেন। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম বুড়ো রিফার কপালে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলেন রিফা
মনি কেমন আছ। রিফা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো ঠোটটা যেন একটু নড়ে ইঠলো এবং ওর
মূখটা থেকে মলিনতা যেন উবে গেল। সেই অসুস্থ শরীরেও সে উঠে বসতে চেষ্টা করলো।
আম্মু ওকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। রিফা
ক্লান্ত হাতটা উচু করে বুড়ো রিক্সাওয়ালার মূখে হাতটা ছোয়ালো। বুড়ো রিক্সাওয়ালার
মূখ ভর্তি সাদা দাড়ি। গায়ে ঘামে ভেজা ময়লা ছেড়া শার্ট। সেদিনের পর এই প্রথম রিফা
কথা বললো। ও ভাল আছে। আমারও খুব ভাল লাগলো যে রিফা কথা বলছে। শাকিল চাচ্চু ওর
অস্থার উন্নতি দেখে আশ্চর্য হলেন। ঢাকায় নেয়ার আর দরকার হলনা। তিনদিনের দিন রিফা
পুরোপুরি সুস্থ হল। এ তিনদিনই বুড়ো রিক্সাওয়ালা ওকে দেখতে এসেছে আর আমার রাগ মাথায়
উঠেছে। বাবার ভয়ে আমি তাকে কিছু বলতে
পারিনি। বুগো রিক্সাওয়ালা প্রতিদিনই একটা দুটো কলা কিংবা পেয়ারা নিয়ে এসেছে। আর
রিফারও আক্কেল বুদ্ধি কম। নোংরা মানুষটার এনেদেয়া সেই কলা পেয়ারা খেয়েছে। আমার
ঘেন্না লেগে গেছে। রিফা সুস্থ হওয়ার পরও আমার সাথে কথা বলেনি। আমার এত আদরের বোনটা
আমার সাথে কথা বলেনা! আমার বুকটা ফেটে যায়। কোন না কোন ভাবে সে আমাকে এড়িয়ে চলে।
অথচ ওকি জানে যে ওর অসুস্থতার এ কয়দিনে ওর চিন্তায় আমি ঘুমোতে পারিনি স্কুলে মন
বসাতে পারিনি। আর মাত্র তিনদিন পর বিজয় দিবস।
বিজয় দিবসে আমাদের স্কুলে মুক্তিযুদ্ধের
ওপর গল্প বলতে হবে ভেবে মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে লেখা একটা বই খুব মন দিয়ে পড়ছি। এই যে
আমি বাংলায় কথা বলছি স্বাধীন ভাবে স্কুলে যাচ্ছি আমাদের নতুন লাল মারুতি গাড়ি
হয়েছে সব মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ না করলে আমি
এতো কিছু পেতামনা। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমার শ্রদ্ধায়
মাথা নত হয়ে আসে। আমাদের সুখের কথা ভেবে তারা যুদ্ধ করেছে। কেউ শহীদ হয়েছে কেউ
ফিরে এসেছে। এই সোনার বাংলার প্রতিটি ইঞ্চি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঋণী। কোন কিছুর
বিনীময়ে সে ঋণ শোধ হবার নয়। আমি কোন মুক্তিযোদ্ধাকে কাছ থেকে দেখিনি। যদি দেখতাম
তবে তার হাতদুটো ছুয়ে দেখতাম।
আদুরে গলায় বলতাম আপনি এই দুটো হাত দিয়ে
পাকিস্তানিদের ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এই দুটো হাত আমার মাথায় রাখুন আমি এ হাতের
স্পর্শে আপ্লুত হই। সেই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্ব। আমাদের অহংকার। তাদের জীবন
বাজি রেখে যুদ্ধ করা দেশে বুড়ো রিক্সাওয়ালারা কেবল ঘামের দুর্গন্ধই ছড়াচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের কথা পড়ার সময় ওই বুড়ো রিক্সাওয়ালার কথা ভাবতে ভাল লাগছেনা। সেই সব
সোনালী ইতিহাস আমার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। স্কুলের অনুষ্ঠানে আমি সেসব খুলে
বলবো। বিজয় দিবসে সকালে সব শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা ফুল দিলাম। বন্ধুরা সবাই
মিলে অন্য ক।লাসের বড়দের নিয়ে আমরা স্কুলেই একটা স্মৃতিসৌধ বানিয়েছিলাম। বিকেলে
গল্পবলা শুরু হল। আমি মঞ্চে উঠে বলতে শুরু করলাম। এমন ভাবে বলছিলাম যেন সদ্যই আমি
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছি।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার ভালবাসা ও
শ্রদ্ধার কোন শেষ নেই। আমার কথা শেষ হলে সবাই করতালি দিয়ে উঠলো। মঞ্চ থেকে নামার
সময় হটাৎ দেখলাম প্যান্ডেলের শেষ দিকে সেই বুড়ো রিক্সাওয়ালাও হাত তালি দিচে।ছ।
অন্য সময় হলে রাগ হত। আজ বিজয় দিবসে রাগটা দমিয়ে রাখলাম। একে একে আরও কতজন বললো।
একসময় রিফাও মঞ্চে উঠলো। ও বলতে শুরু করলো আমি নিবিষ্ট মনে শুনতে লাগলাম। “আমি কোন গল্প বলবোনা, মুক্তযুদ্ধ কোন
গল্পনয়। মুক্তি ডুদ্ধ আমাদের স্বর্ণালী ইতিহাস। রিফা এভাবেই বলতে শুরু করলো। যেন
ফোরে পড়া রিফা নয় বরং কথা বলছেন আমাদের বাংলা মিস হোসনে আরা।
রিফা বলেই চলেছে “ আমি একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ।ধাকে
চিনি তার হাত দুটো অসম্ভব কোমল অথচ একদিন ঐ হাতে সে রাইফেলের গুলি ছুড়ে পাকিস্তানী
সৈন্যদের ঘায়েল করেছে। সে আমার বন্ধু। আমি তার জন্য রোজ স্কুল শেষে অপেক্ষা করি।
আমি তার সাথে রোজ বাড়ি ফিরি। সে আমাকে যুদ্ধ দিনের কথা বলে। সে আমার বন্ধু। আমাদের
দিনগুলো বেশ আনন্দেই কাটছিল। হঠাৎ আমার বাবা গাড়ি কিনলেন আর আমাদের বন্ধুত্ব
ভেঙ্গে যেতে লাগলো। বাবা আমাকে টিফিনের জন্য টাকা দিতেন রিক্সা ভাড়া দিতেন। আমি
টিফিন খেতামনা সব সেই মুক্তিযোদ্ধাকে দিতাম। সে নিতে চাইতো না আমি তাকে বলে রাজি
করিয়েছিলাম যে যে মক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়েছে,কিছু করতে পারেনা এমন
কেউ থাকলে তাকে দিবেন। সে তাই করতো। অথচ একদিন আমার ভাইয়া তার সাথে খারাপ ব্যবহার
করলো। দুই দিন খারাপ ব্যবহার করলো এমনকি সেই মুক্তিযোদ্ধাকে বাজে কথা বললো। আমি
আমার ভাইয়াকে খুব ভালবাসি তাই তাকে কিছু বলতে পারিনি।
আমি সেই মুক্তিযোদ্ধাকে আমার ভাইয়ার
চেয়েও বেশি ভালবাসি তাই তার অপমান সহ্য করতে পারিনি। আমি ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
একদিন যে মানুষটি জীবন বাজি রেখে দেশের বিপদের দিনে যুদ্ধ করেছিল সেই মানুষটি
আমাকে দেখতে আসলো। আমার কপালে হাত রাখলো। শাকিল চাচ্চু বড় ডাক্তার কিন্ত আমি সুস্থ
হইনি। সেই মুক্তিযোদ্ধা আমার কপালে হাত রাখলো আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। যারা বলছে
সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাকে সামনে পেলে তাদের হাত দুটো ছুয়ে দেখবে তারাই
মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করে। যে হাতে অস্ত্র ধরে আমাদের জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে
এনেছিল সেই হাতদুটো এখন রিক্সার হ্যান্ডেল ধরা। আমি অভাগা সেই রিক্সার সিটে বসে
বাড়ি ফিরছি। সেই মুক্তিযোদ্ধার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার নেই। কিন্ত জানি যে
মানুষ নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা এনেছিল সে আমার এ অপরাধ
ক্ষমা করে দেবে।“
রিফার কথা শেষ হলে কেউ হাতে তালি বাজালোনা।
সবার চোখে পানি। দুটো ঘামে ভেজা খসখসে
হাত তখন আমার মূখে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছি। আমার চোখ বেয়ে অবিরাম বর্ষণ
চলছে। এই দুটো হাত আমার কত আপন কত প্রিয়। এই ঘামের গন্ধ পাওয়ার জন্য আমার মন কত
আকুলি বিকুলি করতো। কদিন আগেও যে হাত আমার অসহ্য লাগতো আজ সে হাত আমি মূখের দুই
পাশে ধরে রেখেছি প্রশান্তিতে বুকটা ভরে উঠছে। আমার পাশে রিফা দাড়িয়ে আছে। রিফার মত
আমিও বিশ্বাস করি জীবন বাজি রেখে যে মুক্তিযোদ্ধা আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনেছিল সে
অনায়াসে আমাকে ক্ষমা করে দেবে। বুড়ো রিক্সাওয়াল মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল দাদুর হাতদুটো
আর ছাড়িনি। সমাজ সংসারেতো তার আর কেউ ছিলন। আর কখনো তাকে রিক্সা চালাতে হয়নি।
বিকেলে স্কুল শেষে বাসায় ফিরে আমি আর রিফা জয়নাল দাদুর গা ঘেসে বসি। রাত বাড়তে
থাকে আর দাদুর শরীরের সাথে দু ভাইবোন লেপ্টে থাকি। দাদুর কথা শুন আর হারিয়ে যাই
একাত্তরে।
বসুনিয়া পট্টি, দিনাজপুর।
No comments:
Post a Comment