হঠাৎ বাসটা
প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। ঝড়ের গতিতে চলছিল বাসটি। অকস্মাৎ হার্ড ব্রেক চাপাতে আমি সামরে সীটের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে
পড়লাম। আমার কপাল আর নাক সামনের সীটের সাথে গুতো খেল। নাকে লাগার কারণে চোখ দিয়ে সাথে সাথে পানি
বের হয়ে আসলো। আমি ঝাপসা চোখে দেখলাম সামনে একটা প্রকান্ড ট্রাক বিদ্যুৎ গতিতে
ঠিক আমাদের বাসটার দিকে ছুটে আসছে। আমাদের বাসটা ব্রেক করেছে সাধ্যমতো একটানা
যান্ত্রিক আওয়াজ আসছে। রাস্তার সাথে টায়ার ঘষা খাওয়ার শব্দও আসছে। বাসটি পিছলে
এগিয়ে যেতে যেতে থেমে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রাকটির গতি কমানোর কোন লক্ষনই
দেখা যাচ্ছেনা। ট্রাকটি এতো কাছাকাছি চলে এসেছে যে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া আর সম্ভব
নয়। প্রচন্ড গতি নিয়ে ট্রাকটা বাসটির পাঁচ হাতের মধ্যে
চলে আসলো। আমার কোন রকম হিতাহিত জ্ঞান নেই। হৃদপিন্ড লাফ
দিয়ে গলায় উঠে এসে থেমে গেছে। ওটার আর কোন রকম অস্তিত্ব আমি টের পাচ্ছিনা। দুটো
গাড়ির উইন্ডশীল্ড একটা আর একটার উপর যে কোন মুহূর্তে আছড়ে পড়বে। পুরো ব্যাপারটা দু সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে গেল। আমি
দু কানে কোন শব্দ পাচ্ছিনা। জগৎ যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছে।
একেবারে শেষ মুহূর্তে ট্রাকটি ঠিক একহাত
দূরে থাকতে সবকিছু থেমে গেল। ঠিক সেই সময় পুলের উপর বসে থাকা ছেলেটি
বড়শিতে একটা মাছ গেথে ফেললো। মাছটি বড়শির সাথে শুন্যে ঝুলছে। আমি
এতো দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম মাছটির চোখ টকটকে লাল। ছেলেটি মাছটি ধরার জন্য হাত বাড়ালো। ঠিক
এই সময় সব কিছু থেমে গেল। বাস, ট্রাক ও ছেলেটি এবং আশে
পাশের সব কিছু একেবারে স্থির নিশ্চল হয়ে গেল। কেউ যেন একটা
পজ বাটনে চাপ দিয়েছে। দু একজন বাসের জানালা দিয়ে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারাও শুন্যে
আটকে আছে। আমার পাশের ভদ্রলোক গলাফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিলেন তার মূখ হা করা অবস্থায়
স্থির হয়ে আছে। আমি শত চেষ্টা করেও একচুল নড়তে পারছিনা। শুধু দেখতে পাচ্ছি সব স্থির। অনন্তকাল
না অল্প সময় আশেপাশের সবকিছু স্থির হয়ে ছিল বলতে পারবোনা। চারপাশে হঠাৎ
করে ঘোলাটে হয়ে আসে আর কুয়াশার মতো একটা ধোয়াটে ভাব ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে
আস্তে ধোয়াটে ভাবটা কেটে যেতে থাকে। কিন্তু
কোন কিছুই আগের মত পরিষ্কার হয়না। আশেপাশের সমস্ত পরিবেশ মোমের মত গলে গলে
পড়তে থাকে। বাস,
বাসের জানালার কাঁচ, পর্দা, সীট সব গলে যাচ্ছে।
ষ্টিয়ারিং, গীয়ার, স্পীড মিটার গলে যাচ্ছে। পাশের
সরিষার ক্ষেত,
বাবলা গাছ, মেহগণি গাছের পাতা ও
ডালপালা গলে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের লতানো গাছগুলো আর ঝোপঝাড় গলে
যাচ্ছে। মাঠের মধ্যে বেঁধে রাখা গরু ও বাছুর গলে যাচ্ছে। পুল
এবং পুলের উপরের মৎস্য শিকারী ছেলেটা গলে যাচ্ছে। তার
বড়শি এবং বড়শির মাথায় গাথা মাছ গলে যাচ্ছে। বাসের মধ্যে
সমস্ত যাত্রী গলে যাচ্ছে। সব কিছু নিজের যায়গায় স্থির হয়ে আছে। শুধু মোমের মতো
গলে গলে টপটপ করে পড়ছে। আমিও গলে যাচ্ছি। আমার হাতের আঙ্গুল থেকে গলে গলে নিচে পড়ে
যাচ্ছে। একটা সিনেমা দেখেছিলাম ‘দ্যা হাউস অব ওয়াক্স’। ঐ সিনেমাতে এই রকমের কান্ড কারখানা ঘটে। আশে পাশের সবকিছু
সম্পূর্ণরুপে গলে যাওয়ার আগেই আমার চেতনা লোপ পেল। আমি কিছু দেখতে
পারছিনা,
মনে হয় আমার চোখ গলে গেছে। আমি জ্ঞান
হারালাম। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আমি বাসের সীটে বসে আছি চারপাশে মারাত্মক
ঘনকুয়াশা। বাসের বাইরে এক ইঞ্চিও দেখা যাচ্ছেনা। বাসের
প্রত্যেকটা যাত্রী স্থির কেউ একচুলও নড়াচড়া করছেনা। সবকিছু এখনও কি
পজ করা আছে।
এসব আসলে ঘটছেটা কি।
No comments:
Post a Comment