একুশ কেন বিশ্ব
মানবের
মোঃ আব্দুস ছালাম
১৯৪৮ সাল। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন পাকিস্তানের প্রথম
গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
স্থান কার্জন হল।
জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যের এক পর্যায়ে তার কন্ঠ থেকে উৎসারিত হল পাকিস্তানের
সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী মানুষের জন্য এক হৃদয় বিদারক উচ্চারণ-
Urdu shall be the state language of Pakistan.
খুব সহজাত কারণেই সমাবেশ স্থল থেকে মৃদু অথচ ইস্পাত কঠিন
প্রতিবাদ ধ্বনিত হল, No No, আমরা মানিনা।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই প্রতিবাদ?
পরবর্তীতে কেনইবা এ প্রতিবাদ প্রতিরোধে রুপান্তিরিত হয়। কেনইবা
গোটা জাতি ক্ষোভের আগুনে এক জীবন্ত বিসুভিয়াসে পরিণত হয়,
কেনইবা বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির তপ্ত বুলেট বুক পেতে
নিলেন জাতির বীর সন্তানেরা,কেন রাজপথ রঞ্জিত হলো বরকত,সালাম,রফিক,জব্বার, শফিউর সহ
জাতির আরো অনেক সূর্য সন্তানদের। এ প্রশ্নের গভীরতা যদিও বহুদূর বিস্তৃত তবে
তাৎক্ষণিক জবাব একটাই আর তা হচ্ছে, আমি আমার মাকে ভালবাসি,ভালবাসি মাতৃভূমিকে।
এ ভালবাসা
নিজের জীবনের চেয়ে বেশি। রক্ত রাঙ্গা একুশ তারই প্রমাণ।
এখানে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, আমি আমার
মাকে; মায়ের ভাষাকে যেমন ভালবাসি, ঠিক তেমনি পৃথিবীর সকল দেশে, সকল প্রান্তে, সকল
জাতি তার নিজস্ব মাতৃভাষাকে ভালবাসে।
আমার ভাষাকে
কটুক্তি করলে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করলে, কিংবা অবদমিত করার চেষ্টা করলে আমি যেমন
ব্যথিত হই,আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, ঠিক একই ভাবে যে কোন জাতির ভাষার অমর্যাদা হলে
তারাও ব্যথিত হয়।
তাই একুশ আমাদের শেখায়, আমরা যেমন আমাদের মাতৃভাষাকে
ভালবাসি, সম্মান করি,তেমনি বিশ্বের সকল জাতির, সকল ভাষাকে সমভাবে সম্মান করবো। সকল
ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজনে সে জাতির পাশে দাড়াবো। এ বোধ, এ অনুভূতিই আমাদের
জাতীয় শহীদ দিবস তথা অমর একুশের মূল স্পিরিট,প্রকৃত শিক্ষা। এই চেতনা বোধ এই
স্পিরিট আমাদের রক্তের দামে কেনা একুশে ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের
মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে;
জাতি হিসেবে আমাদেরকে করেছে গর্বিত,মহিমান্বিত।
এ জন্যই আমার
মায়ের ভাষা বাংলা আজ বিশ্ব মানবের ভাষা। আমাদের দেশেও বাংলা ভাষী জনগোষ্ঠীর বাইরে
প্রায় ২৫টি ক্ষুদ্র উপজাতি/আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী যুগ যুগান্তরব্যাপী বসবাস করে আসছে। প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও
সংস্কৃতি। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যেমন রয়েছে মমত্ববোধ, তেমনি তাদেরও নিজ নিজ
ভাষার প্রতি রয়েছে ভালবাসা। তারা যেন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলা,লেখা পড়ার অধিকার
সমভাবে ভোগ করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা আমাদের একান্ত জরুরি। আমাদের
ব্যক্তি,সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা এমন কিছু করবোনা যা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির
উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করে বরং ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্বাতন্ত্র বজায় রেখে
জাতীয় জীবনে আমাদের সাথে তারা যেন সমান তালে সামনে এগিয়ে যেতে পারে সে পরিবেশ
সৃষ্টি করার দায়িত্ব আমাদেরই।
বস্তুতঃ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে
আমরা যেমন লালন করবো, তেমনি আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির মাতৃভাষার প্রতি
শ্রদ্ধাশীল থাকবো এবং সে মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে তাদের পাশে দাড়াবো। তবেই
আমাদের রক্তস্নাত একুশ তথা আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে উঠবে আপন মহিমায়
বাঙ্ময়,হয়ে উঠবে হিরন্ময়।
বিশ্বের সকল
মানুষের জন্য একুশ হয়ে থাকবে আলোর দিশারী।
No comments:
Post a Comment