সূর্য ডুবে যাবে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। এমন সময় আবার
ঝড়ো বাতাস উঠলো এবং আস্তে আস্তে বেগ বাড়তে থাকলো। ঠিক আগের দিন সন্ধ্যার সময় যেটা
হয়েছিল তাই হলো। খানিক পরে পাথর গড়াতে শুরু করলো। আমরা সবাই দৌড়ে বাসে উঠলাম।
ক্লান্ত তিনজনের উঠার বা চলার শক্তি নেই। কেউ কেউ ওদের সাহায্য করার জন্য ধরে ধরে
বাসের দিকে আনতে লাগলো। হঠাৎ একটা প্রকান্ড পাথর বাসের সাথে প্রচন্ড জোরে গুতো
মারল। বাসটি পেছনে সরে গেলে সামনের অবশিষ্ট চাকাটি ভেঙে গেল। বাসের ভেতর সবাই সীটের
উপর মেঝেতে আছড়ে পড়লো। পাথরটা বাসকে জোরে ধাক্কা দেওয়ার কারণে কিছুটা পরিবর্তিত
পথে ছুটে গেল এবং ক্লান্ত তিনজন এবং তাদের সাহায্যকারীদের পিষ্ঠ করে দিয়ে চলে
গেল। সব কিছু থামলে আমরা হতাশ ভাবে বসে
থাকলাম। একটু আগে সাতজন মারা গেছে। আমাদের মধ্যে মোট নয়জন মৃত এবং আরো নয়জন নিখোজ।
আমরা কেউ কোন কথা বলছিনা শুধু বালির উপর পা ছড়িয়ে বসে আছি। হঠাৎ করে দূরে চিৎকার
শুনলাম। বাসের হেল্পার পশ্চিম দিকের তিনজনের সাথে গিয়েছিল। চিৎকার করতে করতে ছুটে
আসছে। পেছনে আসছে কয়েকটি জোনাকী পোকা। আরো কাছে আসতে বুঝতে পারলাম ওগুলো জোনাকী
নয়। শেয়ালের মত প্রানী। শেয়াল থেকে কিছু বড় কুচকুচে কাল শরীর। সেই শরীরে গোল গোল
ছোপ, রেডিয়ামের মত জ্বলছে, যেন প্রত্যেকটাই চোখ। কেউ টর্চের আলো ফেলতে এই দৃশ্য
দেখতে পেলাম। কি করা এখন। আশ্রয় স্থল বলতে ভগ্নবাসটি। সবাই বাসে উঠে দরকার বন্ধ
করে দলাম। শেষ মূহুর্তে হেল্পারটি উঠতে পারলো। বাসের জানালাগুলো আগে থেকেই বন্ধ ছিল।
ডজন খানেক আজব প্রানী বাসের জানালার কাঁচ আর সামনের প্রায় গুড়িয়ে যাওয়া
উইন্ডশীল্ডের উপর এসে হামলা চালালো। সেই সব প্রানীরা প্রচন্ড আঘাত করে কাচ ভেঙ্গে
বাসের ভেতরে ঢুকে পড়লো। এমন সময় কে একজন বাসের ভেতরের বাতি গুলি জ্বেলে দিল সাথে
সাথে প্রানী গুলি লাফিয়ে বের হয়ে গেল। আমি দেখলাম যে আলো জ্বালিয়েছে সেই লোকটাই
টর্চ মেরেছিল। টর্চের আলোতে প্রানীগুলো সরে যাচ্ছিল। লোকটা হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল
করেছে।
পরে হেল্পারের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওদরে বাকি দু’জনকে
ওই প্রানীরা ধরে খেয়ে ফেলেছে। মাঝরাতের দিকে বাসের আলোগুলি ম্লান হয়ে আসলো এবং
ধীরে ধীরে নিভে গেল। ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছিল।হয়তো লোকটা টর্চটা জ্বেলে বসে থাকল
কিন্তু প্রানীগুলো খুবই নিকটে ঘোরাফেরা করতে লাগলো। একসময় সামনের দিকে একটি প্রানী
ভাঙ্গা কাঁচের ফোঁকর গলে আসতে চেষ্টা করলো। লোকটি টর্চের আলো ফেললো। প্রানীটির মূখ
অদৃশ্য হলো। কিন্তু জানালা থেকে এক সাথে দুইটা লোকটির উপর লাফ দিল। একটা লোকটার
হাত কামড়ে ধরলো। হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। সাথে সাথে এক গাদা প্রানী বাসের মধ্যে
হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। সবগুলো প্রানীর বিশ্রী কালচে দেহ। অনেক লম্বা দাত। হা করে
আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর তখনই ব্যাপারটার পূণরাবৃত্তি শুরু হল। সব কিছু স্থির
হয়ে গেল।
প্রানী গুলি এবং বাসের সবাই, আমি তারার আলোয় দেখতে পেলাম
সব কিছু পজ হয়ে গেছে। এবং তারপর আবার সেই ‘দ্যা হাউস অব ওয়াক্স’ সিনেমার মত সবকিছু
গলতে শুরু করলো। প্রানীগুলি, মানুষ গুলি, আমাদের বাসটা আশেপাশের পাথর এমনকি
তারাগুলোও মোমের মত গলে গলে পড়তে লাগলো। আমার যখন জ্ঞান ফিরলো আমি তখন আমাকে একটা
হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করলাম। পরে শুনেছি আমি দুইদিন অজ্ঞান ছিলাম। বাস এবং
ট্রাক সংঘর্ষে বাসের ১৭ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে দুইজন মহিলা ছিল। পরে আমি খোঁজ
খবর করে জেনেছি আমার স্বপ্নে যারা মারা গেছিল বা নিখোঁজ হয়েছিল বাস্তবেও
অ্যাক্সিডেন্টে তারা মারা গেছিল। আমি অ্যাক্সিডেন্টে বেঁচে যাওয়া মানুষদের সাথে
কথা বলেছি। কেউ কোন স্বপ্ন বা অন্যরকম কিছু দেখেছে কিনা মনে করতে পারেনা। আকরাম
নামে একজন শুধু অদ্ভুত কিছু কথা বললো। সে কুষ্টিয়া চৌড়হাস থাকে,ব্যবসার কাপড় কিনতে
ঢাকা যাচ্ছিল। সে বিশ্বাস করে বাসটিকে কোন জ্বীন তুলে নিয়ে তাদের দুনিয়ায় নিয়ে
গিয়েছিল। এবং পরে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। কি কারণে জ্বীন এরকম করলো জিজ্ঞাসা করলে
আকরাম বললো আমি কি জানি; জ্বীন জানে। আমি ক্যামমা করে কব।
ফোর্থ ডাইমেনশনাল ডোর
থিয়রামটা এ ঘটনার ব্যাখ্যার জন্য খারাপ না। শুধু একটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করা
যাচ্ছিলনা। পাথর গুলি গড়ায় কেন। পাথরগুলিতে আসলে ধাতুর পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। ধাতু
চৌম্বকশক্তি দ্বারা আকর্ষিত হয়। পাথর গড়ানোর ঘটনা দুইবার ঘটেছিল, দুইবারই
সূর্যাস্তের সময়। ধরে নেয়া যেতে পারে মহাশুন্যের ঐ এলাকায় নির্দিষ্ট সময় পর পর কোন
মহাজাগতিক কারণে শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয় এবং তা কিছু সময়
সক্রিয় থাকে। ঠিক ঐ সময় ধাতব পাথরগুলি তাতে আকর্ষিত হয়ে আকর্ষণের অভিমূখে চলতে
শুরু করে। বাসটিও যেহেতু ধাতব ছিল তাই ঐ আকর্ষনে সাড়া দেয়। কাজেই এটা অসম্ভব কিছুই
নয় যে বাস-ট্রাক সংঘর্ষের মূহুর্তে আমি আমার বাস ও যাত্রীরা অন্য কোন স্পেসটাইমে
ঢুকে গেছিলাম এবং সে একই পথে ফিরে আসি। যেহেতু অন্য এক স্পেসটাইমে অনাকাঙ্খিত
বস্তুর উপস্থিতি ও স্পেসটাইমের ভারসাম্য
নষ্ট করে, যতক্ষণ না বস্তু সমূহ তার নির্ধারিত স্থান কালে ফিরে আসে। যার ফলে
বাস্তব ক্ষেত্রে স্পেসটাইমে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং বাস্তবতা অল্পখানিকটা পরিবর্তিত
হয়ে যায়। বাস্তবে হয়েছেও তাই। আমার মোবাইলের ক্যামেরার সবগুলি ছবি সরিষা ফুলের ছবি
বাসের জানালা দিয়ে তোলা। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে আমি এ টাইপের
কোন ছবি তুলিনি। এখন ব্যাপারটা দুইভাবে বিশ্বাস করা যায়। আমার মাথায় আঘাত লাগার কারণে আমি দুইদিন অজ্ঞান ছিলাম। তাই তার আধাঘন্টা একঘন্টা আগে (দশ-পনের
মিনিট আগে) আমি কি করেছি আমার মনে নেই। হয়তো সরিষা ফুলের ছবি তুলছিলাম। অথবা আমি
কোন পরাবাস্তব জগতের ছবি তুলেছি, সেই সব পাথর আর অন্যান্য কিছু। স্পেসটইমের আলোড়ন
সঠিক বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে ঐ সব ছবিগুলোকে সরিষা ফুলের ছবি করে দিয়েছে। ছবিগুলি এখনো আমার কাছে আছে,কেউ
চাইলে দেখাতে পারি।
No comments:
Post a Comment